সম্পাদকের কলমে--

সম্পাদকের কলমে--

প্রত্যেক পত্রিকায় সম্পাদক থাকা যেমন অবশ্যম্ভাবী, ঠিক তেমনি সম্পাদকীয় লেখা অনেকটা অনিবার্য হয়ে পড়ে l আমাদের এ বারের সংখ্যা ভৌতিক, অলৌকিক বা পারলৌকিক l

ভয় মানুষকে তাড়িয়ে ফেরে l মানুষ যখন অলৌকিকতার সামনে এসে পড়ে তখন সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, সে হতবাক হয়, বিস্মিত হয় l অলৌকিকতার অজানিত অদ্ভুত ক্রিয়া-কলাপগুলি মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে থাকে, তাকে আতঙ্কিত ও শঙ্কিত করে তোলে। আসলে, প্রত্যেকটি মানুষ মৃত্যু ভয়ে আটকে--মৃত্যু মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় ভয় ও রহস্য। আমাদের মস্তিষ্ক নামক যন্ত্রটি জগতের সবচেয়ে উন্নততর একটি যন্ত্র, এখানে তুলনাগত মান ধরলে সমস্ত মানবিক আবিষ্কারের ব্যাপারগুলি ফেল পড়ে যায় l এই ফেল বা অকৃতকার্যতার ফলস্বরূপ উঠে আসে অলৌকিকতা--সে কারণে আজও মানুষ ভূত ভৌতিক প্যারানরমাল ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ । আমাদের সমস্ত জ্ঞান পরিধির সীমানার পর থেকেই সমস্ত অলৌকিক ঘটনার সূত্রপাত ঘটে l বিজ্ঞানের কার্যকারণ সম্পর্ক সেখানে পূর্ণত অসফল।

মনের পরিচালক হল মস্তিষ্ক l আর মস্তিষ্ক বা ব্রেইন হল অটো জেনারেটর অফ থিংকিং--এটা একটা ডায়নামিক প্রক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া। মস্তিষ্কের কিছু সূক্ষ্ম সেলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকেই হয়ত আমাদের ভূত ভৌতিক প্যারানরমাল অবস্থানগুলির সৃষ্টি। মস্তিষ্কের অণু-পরমাণুর যান্ত্রিক ঘটনাগুলি আমাদের ভুল দর্শনের চিত্রপট হয়ে উঠে আসতেই পারে।

ভাবনা কল্পনা কাহিনী গড়ার জন্য আমাদের মন বড় পটু থাকে । এক শুনলে বা দেখলে তাকে একশ বানিয়ে গল্প করা মানুষের স্বভাব বললে, ভুল হবে না। আরও যেখানে এক জাগায় এসে আমরা ভীত ও অজ্ঞাত সেখানে ভৌতিক বা প্যারানরমাল ব্যাপারে আমরা খুব ভাবি, তাকে আরো অবাস্তব কল্পনা মেখে মনের মাঝে ধরে রাখতে চাই।

কোন মানুষ বা প্রাণী মরলে তাঁর আত্মা মানে অতৃপ্ত আত্মাই নাকি ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই ভূত ও ভৌতিকতা যখন সাহিত্যাকাশের স্রোতে এসে পড়ে তখন লেখকদের রহস্য-ভাবনা নির্বাধ উড়ে বেড়ায় । মানুষের বুদ্ধির মাপকাঠির শেষ থেকেই তো শুরু হয় রহস্যময়তা, আসল রহস্য সেখানে আরও ঘনীভূত হয়ে পড়ে।

শেষমেষ যদি প্রশ্ন আসে, ভূত বলে কি আদৌ কিছু আছে ? উত্তরে, না, বললে, আমি বলবো ভুল বলছেন। আসলে আপনি এ ব্যাপারে অজ্ঞ। মন বুদ্ধির নাগালের বাইরের ব্যাপারটাই হল অলৌকিকতা। ভগবান, দেবতা, অপদেবতা, এদেরকে বিশ্বাস করতে হলে ভূতকে বিশ্বাস করা যাবে না কেন ? আসলে অলৌকিকতার মধ্য থেকেই উঠে আসে ভুত-প্রেত, আমাদের মানসিক অসুস্থতা বা মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম ব্যতিক্রমের মধ্যেও ভুত প্রেত লুকিয়ে থাকতে পারে। এত কিছুর পরেও এই একই প্রশ্ন আমাদের মনে বারবার উঠে আসে--ভূত বলে কি আদৌ কিছু আছে ? কেউ বলেন আছে। কেউ বলেন, নেই, কিন্তু "অলৌকিকতা" ব্যাপারটা যে সত্য, তা নিয়ে আমাদের মনে কোন দ্বিধা নেই। আর আমি বলব, এই অলৌকিকতার মধ্যে থেকেই ভুত-প্রেত উঠে আসে। অনেকের কাছে তা বাস্তবেও প্রকট পায়।

ভূতের ব্যাপারে আমিও এক বিশ্বাসী প্রাণী। আমার কথা কারও বিশ্বাস না হলে আমার তাতে কিছুই আসে যায় না। গল্প হিসেবে ভূতের গল্প পাঠকের উত্তেজনা বাড়ায়, রোমাঞ্চ জাগায়, আসলে রোমাঞ্চিত হওয়ার উপাদান মানুষের মনের মধ্যেই বিদ্যমান।

সে যাই হোক, আসুন বন্ধুরা, পড়ুন আমাদের এবারের ব্লগ ও ই-পত্রিকা। আমাদের বর্তমান সংখ্যার বিভিন্ন ভৌতিক গল্পগুলি পড়ে রোমাঞ্চিত হোন। আবছা অন্ধকার, পোড়ো বাড়ি, ছায়া দর্শন, ফিসফিস কথা, হঠাৎ হওয়ার ঘূর্ণিঝড় সব মিলিয়ে বিচিত্র সব কাহিনীর কথা অঙ্কিত হয়েছে আমাদের বর্তমান ভৌতিক বা প্যারানরমাল সংখ্যায়। শুভকামনান্তে--তাপসকিরণ রায়।

সহ সম্পাদকের কলমে--

এত দিন সম্পাদকের কলমই দেখেছেন আমাদের এই ব্লগের পত্রিকায়। এবং সেটাই স্বাভাবিক। সহকারী হিসেবে এটাই বলবো, আপনারা পত্রিকাটি পড়ুন এবং স্পষ্টভাবে মতামত জানান। কি ভাবে আমরা পত্রিকাকে আরও ভালো করতে পারি। আমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে কি না। আমাদের উদ্দেশ্য আমরা ভালো লেখা হলেই সেটা প্রকাশ করবো। বারবার সম্পাদককে বলতে হবে না আমার লেখাটার কি হল। আমাদের কোন চেনা জানা কাজ করে না। আমার লেখাটা চিনি। তাই আশা রাখি আপনারা আমাদের সাথে থাকবেন এবং সম্পাদককে পত্রিকা এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন। ধন্যবাদান্তে--শমিত কর্মকার, সহ-সম্পাদক, বর্ণালোক।

সহ-সম্পাদকের কলমে--

আমাদের নিত্যদিনের চেনা শোনা জগতের বাইরেও যে একটা অজানা অদেখা জগত আছে, একথা অনেকেই বিশ্বাস করেন। অনেকে আবার এসব বিশ্বাস করতে চান না। আছে আর নেই এ বিষয়ে অদ্যাবধি তর্কও বড়ো কম হয়নি। পারলৌকিক জগতে বিশ্বাসকে দৃঢ় করতেই হোক বা অজানা তথ্য আহরণের জন্যই হোক বসেছেন প্ল্যানচেটে, আবার মজার কথা হল এই যিনি এই ব্যপারে অবিশ্বাস করেন তিনিও তার অবিশ্বাসের ভিত সুদৃঢ় করতে ঐ একই পন্থা নেন।

বিশ্বাস আর অবিশ্বাস যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। আবার এটাও ঠিক এমন অনেক ঘটনা ঘটে থাকে যার ব্যাখ্যাও যুক্তি বুদ্ধির অতীত।

বর্তমানের নূতন করে প্যারানরমাল বিষয় অর্থাৎ আধি দৈবিক কিংবা আধিভৌতিক বিষয়ে চর্চার জন্য তো রীতিমত আগ্রহ দেখা গেছে। একাংশের মধ্যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে অনেক সংগঠনও তৈরি হয়ে গেছে। এবারের অণুগল্পগুলির মধ্যেও এসে পড়েছে সেই অজানা-অদেখা অতীন্দ্রিয় জগতের কিছু কিছু কথা।ধন্যবাদান্তে--সাবিত্রী দাস, সহ-সম্পাদক, বর্ণালোক।

শনিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০২১

কাবেরী তালুকদার


 

জয়ী ভালোবাসা-- 

কাবেরী তালুকদার

 

ও হো, আপনি এসে গেছেন ? ঠিক আছে একটু বসুন, আমি নাইট সিফপ্টের, এটাই মনে হয় শেষ, সাইকেল রেখে আসছি।হ্যা, এবার বলুন ভাই।তবে যা দেখতে এসেছেন, ভয় পেলে কিন্ত চলবে না। কি বললেন, আমার ভয় করে কি না?

না ভাই আমার ভয় করে না।আসলে অনেক দিন ধরে ঘটে চলেছে তো ঘটনাটা, তাই আর ভয় করে না। এ কি, না না সিগারেট খাবেন না এখানে। আর ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ওরা এসে যাবে। দাড়ান, ওদের সাইকেল দুটো বাইরে রেখে আসি। একটু ঐ বিছানায় গড়িয়ে নিন না। খাবেন কিছু? ও খেয়ে এসেছেন। চুপ, ওরা আসছে। শুনতে পাচ্ছেন ফিসফিস করে কথা, হাসির শব্দ? একদম চুপ। দরজার ফাক দিয়ে দেখুন যা দেখতে এসেছেন। একটি ছেলে ও চুড়িদার পড়া একটি মেয়ের ছায়া ছায়া অবয়ব এগিয়ে এলো। প্রথমে মেয়েটি সাইকেলটা নিয়ে বেল বাজালো। অনুরনন। জাহাজের ঘন্টা ধ্বনী। এবার ছেলেটি তার সাইকেল নিয়ে বেল বাজালো। যেন ফোনের রীঙ টোন।

অল্প হাসির আওয়াজ। দুজনে সাইকেল নিয়ে ভ্যানিস। দেখলেন ভাই? আমি উঠতে চাইছিলাম। মহিলা বললেন, শুরুটা যখন দেখলেন, শেষটাও দেখে যান। দু ঘন্টার মধ্যে ওরা ফিরে আসবে। ইতিমধ্যে শুনে নিন ওরা কারা। মহিলা দু কাপ চা বানিয়ে এক কাপ আমাকে দিলেন ,আর নিজে নিলেন। বলতে শুরু করলেন, প্রায় ছশ বছর আগে আমি এখানে সাইকেল গ্যারেজ করি। দেখছেন তো মধ্যে মাঠ আর দু পাশে দুটি ছেলে ও মেয়েদের হাই স্কুল। প্রথম সাইকেল রাখতে এলো রীতা ও সুমন। ওরা আরো ছাত্রছাত্রীদের জুটিয়ে আনলো। বেশ দাঁড়িয়ে গেলো আমার গ্যারেজ। দুজনেই ইলেভেনে পড়ে। সুমন পাতি বাঙালি। রীতারা মারোয়ারী। তবে না বলে দিলে বোঝা যায় না। আমার মনে হয়েছিল ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলছিল এ প্রেম বিরাট অশান্তি ডেকে আনবে। সুমনের মা মিউনিসিপ্যালিটিতে পিয়নের কাজ করেন। বাবা নেই। রীতারা বনেদি ব্যাবসায়ী। ভেবেছিলাম যা, ঘটলো তাই। কি করে জানাজানি হল কে জানে। এক দিন ভোর বেলা সুমনের রক্তাক্ত মৃতদেহ পাওয়া গেলো গঙ্গার ঘাটে। পুলিশ নিষ্ক্রিয়। এর দিন সাতেক পরে উদভ্রান্ত রীতা এসে সাইকেল জমা রেখে গেলো। পরদিন সকালে রীতাকে পাওয়া গেলো দ্বীখন্ডিত রেল লাইনে। পুলিশ আর কি করবে। রীতা লিখে রেখে গিয়েছিল,  ওর মৃত্যুর জন্যে,,,,,।

এর ঘটনা সংক্ষিপ্ত ।

সুমনের মা এসে রীতার সাইকেলের উপর সুমনের সাইকেলটা রেখে যান। ওদের ঐ সাইকেরলের অন্য রকম ধ্বনিই বুঝিয়ে দিতো ওরা আলাদা অন্যদের থেকে। ওরা দুজনে মিলে এক। এরপর ঐ জায়গাতেই পড়ে থাকতো সাইকেল দুটো। প্রায় বছর খানেক বাদে রাত বারোটা নাগাদ প্রবল অনুরনন। ওপর থেকে জানলা দিয়ে দেখে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। তারপর রোজই একই সময় ওরা আসে । সাইকেল নিয়ে চলে যায়। আর দুঘন্টা পরে ফিরে এসে সাইকেল রেখে যায়। এখন আর ভয় লাগে না। ছেলে মেয়েরা আমাকে নিয়ে যেতে চায়। যেতে পারি না। এই ভাঙা বাড়ি আগলে সাপ শিয়ালের সঙ্গে বাস করি ওদের জন্যে। ওরা জানে এক জন অন্ততঃ ওদের ভালোবাসার স্বীকৃতি দিয়ে চলেছে। ওরা আসছে । লাইটটা নিভিয়ে দিন ভাই।

                   সমাপ্ত

শুক্রবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২১

ঊশ্রী মন্ডল


 

এটা কি ছিলো ? 

ঊশ্রী মন্ডল 


আমি তখন দিল্লিতে, তিন তলায় খোলা একটা ঘরে স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে ভাড়ায় থাকতাম l পাশের বাড়ির পলি বলল, 'দিদি, হরিয়ার দাদি আজ ভোরে মারা গেলেন l মনটা খারাপ হয়ে গেলো, রোজ যখন ছেলেকে স্কুলে দিতে যেতাম, তখন উনি খুব কথা বলতেন, খুব ভালোবাসতেন গুড্ডুকে l বেরোলাম ছেলেকে নিয়ে স্কুলে দিতে, দেখি হরিয়াদের বাড়ির সামনে বেশ ভিড় l পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম ভিড় ঠেলে, দূর থেকে দেখলাম ওনাকে, প্রণাম জানিয়ে ওনার আত্মার শান্তির কামনা করলাম l তারপর ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে, ঘরে ফিরে ওনার কথাই মনে করছিলাম l হঠাৎ ফোন এলো ছেলের স্কুল থেকে, গুড্ডু অসুস্থ হয়ে পরেছে l আমি সব ফেলে ছুটলাম স্কুলের উদ্দেশ্যে l গিয়ে দেখি গায়ে খুব জ্বর, চোখটা টকটকে লাল , আমি তক্ষনাৎ ছেলেকে নিয়ে গেলাম ডাক্তারখানায় l ঔষধপত্র নিয়ে নিয়ম মত খাওয়াতে লাগলাম l গুড্ডু ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলো l 

সেই দিন হঠাৎ দেখি ও আপন মনে কি যেন বকবক করছে, আমি জিজ্ঞাসা করলে কোনো কথার উত্তর দিচ্ছে না, গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম বেশ জ্বর, আমাকে একদম সহ্য করতে পারছে না, আমার কাছে থাকতেই চাইছে না l 

পলি বললো, ' দিদি আমার কাছে কালীমায়ের জলপোড়া আছে একটু খাইয়ে দেবেন ? মনে হয় উপরে হাওয়া লেগেছে '| 

আমি বললাম, ' বেশ খাইয়ে দাও ' l 

পলি যেই খাওয়ালো, একটু পরেই ও সুস্থ হয়ে উঠলো l পলি এও বললো, পাশের গলিতে একজন ওঝা থাকেন, ওনার কাছ থেকে অবশ্যই যেন ঝাড়িয়ে আনি l আমার স্বামী কিংবা আমি কেউ এই সব বিশ্বাস করতাম না, তবুও নিমরাজী হয়ে ছেলেকে নিয়ে ঐ ওঝার কাছে উপস্থিত হলাম, উনি যথারীতি ঝাড়ফোঁক করে একটা ধাগা হাতে বেঁধে দিলেন আর বললেন, ' এই ধাগা তিন মাস অবশ্যই যেন ওর হাতে থাকে, কোনো মতেই যেন না খোলে ' l 

একদিন ভীষণ গরম পড়াতে বাইরে বিছানা করে শুলাম , হাল্কা হাওয়া বইছিলো, দূর আকাশের তারারাও আমাদের মিটমিট করে দেখছিলোl গুড্ডুর সাথে বকরবকর করতে করতে গায়ে একটা হাত রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না l হঠাৎ আমার হাত কে যেন এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো, চমকে উঠে দেখি গুড্ডু আমার দিকে রাগত অবস্থায় তাকিয়ে আছে, চোখ লাল হয়ে গেছে l বলছে, ' কেন আমার গায়ে হাত দিয়েছিস ? ' বলে সে তার বাবার কাছে চলে গেলো, গায়ে হাত দিয়ে দেখি বেশ জ্বর l তাড়াতাড়ি হাতের দিকে দেখলাম, দেখি ধাগাটা নেই, ছিঁড়ে পড়ে আছে l ভয়ে আতঙ্কে ঐ রাতেই ওঝার কাছে ছেলেকে নিয়ে চললাম l 

তিনি সব শুনে বললেন, আমি আবারও মায়ের কাছে তোমার সন্তানের মঙ্গল কামনায় পূজা করবো l মদসহ আনুষঙ্গিক আরো কিছু কিনে আনার নির্দেশ দিলেন l আমরা আবার সব কিনে নিয়ে ওনার কাছে গিয়ে পূজায় বসলাম l সব শেষে উনি আমার ছেলের হাতে মন্ত্রপূতঃ ফুল দিয়ে একটা তাবিজ বেঁধে দিয়ে বললেন কোনো মতেই যেন এই তাবিজ যেন ওর হাত থেকে না পড়ে l এরপর থেকে যতই গরম পড়ুক না কেন, আমরা আর বাইরে শুই নি l 

আজ আমার ছেলের বয়স ২৫ বছর হয়ে গেলো, আজও আমি ছেলেকে কোনো মৃতদেহের সামনে যেতে দিই না l আচ্ছা এই বিজ্ঞানের যুগে আজও এই সবের অস্তিত্ব আছে ? যা আমি কোনো দিন বিশ্বাস করতাম না তা আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি ! এ কি ছিলো আপনারাই বলুন না l


জেবুননেসা হেলেন

 


আদুল আসুখ


জেবুননেসা হেলেন


বাসমতি চালের ঘ্রাণ ভেসে আসছে কারো উনুনে সেদ্ধ হতে হতে।

ঠিক দুপুর গলানো আধদুপুরে আদুল গায়ের মেঘ গর্জন আসার আগে বিদ্যুৎ চমকে উঠে ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো। চালের ঘ্রাণ হারিয়ে গিয়ে মাটির সোদা ভেজা গন্ধ নাকে ঢুকে যাচ্ছে।

পাশেই সদ্য গতকালের ছাদ পেটানো ছাদে জল জমেছে।জলের ওপর জল পড়ে বুদবুদ ওঠা কিশোরী জল কণাদের দিকে নায়ার চেয়ে আছে মুগ্ধ নয়নে।

ওর কিশোর কাল চলে গেছে বহুদিন। 

আজ ছোট ভাই ও তার স্ত্রীর সাথে বাকবিতন্ডায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে সে।অনেকক্ষণ বসেছিলো বাজারের চায়ের দোকানে।যখন কেউ একজন তার ভাইয়ের নাম নিয়ে দোকানদারকে বলছিলো তাকে খুঁচ্ছে তার ভাই।সে উঠে চলে এসেছে পরশি বড়বোন পারুলের বাড়িতে।এসে বলেছে সে যেনো না বলে সে এই বাড়িতে।

বিয়ের পাত্র খুঁজতে খুঁজতে তার ডাক্তার বাবা আর গৃহিণী মা তার বয়স পাড় করে দিয়েছে সাইত্রিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে যখন সে পড়ে তখন বাবা বার বার মানা করেছে কোনো ছেলের সাথে যেনো কথা না বলে।সে কথা রেখেছে।বাবা সুপাত্রে কন্যা দান করার আগেই গত জুনে করোনায় মারা গেছেন।

ভাই,মা,ভাইবউ কারো আধিপত্য তার এখন ভালো লাগে না।

তার ইচ্ছে করে কেহ একজন তাকে বলুক," আই লাভ ইউ"।

তার সৌন্দর্য কোনো অংশেই কম নয়।পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি দীর্ঘ শরীরটার দিকে একবার সে চেয়ে দেখে।তার জীবন নিঃসঙ্গ।বাবার হাজারো কড়াকড়িতে কিশোরী কালও সে উপভোগ করতে পারে নি।

জীবনকে সে দেখেছে টিভিতে দেখা গল্প কাহিনীতে।

একটা চাকরির দরখাস্ত পর্যন্ত তাকে করতে দেয়া হয় নি।

এখন তার মেজাজ হয়ে গেছে খিটখিটে। কিছুই ভালো লাগে না তার।

অথচ কি নেই তার?

ইশ! বৃষ্টি মেয়েরা কি আনন্দই না করছে।উফ! কি ঘনকালো মেঘ নেমে আসছে দিগন্তরেখায়।ইচ্ছে করছে ওই ছাদে কারো সাথে জল ছিটিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে।

নায়ার আনমনা থাকতে থাকতে খালাত ভাই মিনহাজ ভাইয়ের বউ মালিহা ভাবির ফোন এলো।

-হ্যালো!

-হ্যাঁ ভাবি বলো।

-তুই কই?

- আছি।কেনো?

- না।তোকে খুঁজে সব্বাই হয়রান।কোনো দিন কোথাও যাস না।কই গেছিস?

- ভাবি,আমি ভালো আছি।তুমি আমার খুব প্রিয় বলেই ফোন ধরেছি।তুমি যে আমাকে ফোন করেছো।আমি ধরেছি,কাউকে বলো না প্লিজ!

- হঠাৎ কি হলো? আমি আসি তুই কই বল?

নায়ার ফোন কেটে দিলো।

চোখ পড়ে গেলো পাশের ছাদের, একজোড়া চড়ুই গা ধুচ্ছে...

নায়ার ভাবছে সে কি বাড়ি ফিরবে? নাকি...


পারমিতা ঘোষ


 

সংসারখেলা

-----------

পারমিতা ঘোষ


মাটির সরায় নারকেল ছোবরার ফোঁটা ফোঁটা আগুনের ওপর ধুনো ছিটিয়ে নিয়ে, কমললতা রোজ সকালে একঘর থেকে আর একঘরে ঘুরে বেড়ায়। ছম্ ছম্ করে তার তিন পরতিয়া রূপোর নূপুর ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে শ্বেতপাথরে মোড়া বাড়িটার শিতল আনাচে কানাচে। ভেজা চুলের রাশি থেকে জল ঝরতে থাকে টুপ্ টাপ্। জরি সুতোর ফুলকারি তোলা আঁচলখানি রঙিন ছায়ার মত মেঝেতে লুটিয়ে পিছু নেয়। খাঁচায় সবুজ টিয়া তাকে দেখতে দেখতে ডাক তোলে - "ওগো শুনছো?"

ধূপ ধুনো দেওয়া সাঙ্গো করে,  নিত্যপুজার পালা সেরে উঠতে রোজই বেলা গড়িয়ে যায়। তারপর থাকে রান্নার পাট। নাপিতবৌ যখন আলতাপাতা আর নরুনকাঠি নিয়ে একতলার উঠোনে ঢুকে হাঁক দেয় - "কই গো বউ, ভাত খাওয়া হল তোমার", ততক্ষণে সূর্য ঘেঁটে যাওয়া সিঁদুর টিপের মত দিগন্ত জুড়ে বিছিয়ে যায়।

নাপিতবৌ লক্ষীবারে আসে আলতা পরাতে। সে অনেক রকম খোঁপা জানে, অমৃতিপাক, খেজুরছড়ি, প্রজাপতি। কমললতা প্রথমে হাসি মুখে জাফ্রি কাটা রেলিং থেকে ঝুঁকে পড়ে তাকে দেখে, তারপর দৌড়ে আসে।

আহ্লাদ করে বলে - "দিদি, আজ খোঁপায় তারাফুল গুঁজে দিও।"

- "দাঁড়াও বাপু, আগে জট ছাড়াই! তারপর তো খোঁপা! সোয়ামীসেবায় দিনরাত এক করে দিচ্চো, ইদিকে নিজের পানে নজর নেই। তা আজ কী রান্না করলে?"

- "শুক্তো, মুড়িঘন্ট, পোস্তর বড়া, বেগুন ভাজা, রুইয়ের কালিয়া ..."

- "একা হাতে এত কিচু!"

কমললতার মুখে রক্ত জমা হয়। - "উনি যে পাঁচরকম তরকারি ছাড়া খেতে পারেন না।"

 - "ধন্যি বউ বটে। বলি, উনি কী একটু উটতে হাঁটতে পারচেন এদানিং?"

কমললতা অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়ে। নাপিতবৌ বেরোবার আগে বলে - "সাবধানে থেকো। এত বড় বাড়িতে দুজন মাত্তর থাকো, ভাবতেই ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়।"

- "দূর ভয় কিসের? উনি রয়েছেন তো।"

নাপিত বৌ অপাঙ্গে তাকায়, দোতলার দিকে। দাঠাকুরের ক্ষ্যামতা আছে এমন প্রচন্ড রূপসীকে রক্ষে করার? আজ কতদিন হয়ে গেল ঘর ছেড়ে বেরোতেই পারেন না। এদিকে গাঁয়ের সমস্ত শেয়াল কুকুরের দল যে মাংস খাবার জন্য ওৎ পেতে বসে আচে, সে খবর এনাদের কাছে পৌঁছে দিতেও বাধে। আর বৌটাও হয়েচে তেমনি, নিজের রূপ সম্বন্ধে হুঁশটুকু নেই!


আঁধার গাঢ় হতেই রতন মন্ডল মাঠ ডিঙিয়ে পুকুর পেরিয়ে উঠোনের গায়ে বারফটকের আড়ালে এসে বসে। আবছায়া বারান্দা বেয়ে কমললতার যাওয়া আসা দেখা তার নেশা। যত দেখে নেশা তত গাঢ় হয়। ঐ মোহিনী মূর্তীর স্বামীসঙ্গ, আদর সোহাগের কথা ভেবে ভেবে রক্ত চাগিয়ে ওঠে। এ যে কি নিদারুণ কষ্ট।

শেষ পর্যন্ত আকাশ কালিবর্ণ ধারণ করে। কমললতা সিঁড়ি বেয়ে খাবারের থালা সাজিয়ে, প্রকান্ড ঘরটায় ঢোকে। নাকছবিতে ঝিলিক তুলে স্বামীর দিকে কটাক্ষ হানে।

- "আজ ক্ষীর করেছি তোমার জন্য।"

বারফটকের আড়াল ছেড়ে পূব দিকের তেঁতুলগাছের মোটা ডাল, যেটা রঙিন কাঁচের জানলার বাইরে ঝুঁকে আছে, তাতে বসে রতন শিউরে ওঠে। এমন মধুর স্বর!

কমললতা পরম মমতায় এক চামচ ক্ষীর তুলে, টেবিলের সামনে বিলিতি আরামকেদারায় আসীন স্বামীর, শূন্য মুখগহ্বরে প্রবেশ করিয়ে দেয়।

- "সমস্তটা খাও বলছি। ওগো তোমাকে যে সেরে উঠতেই হবে..."

মসলিনের ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত বিকট কঙ্কাল উত্তর দেয়না। করোটির ফাঁক দিয়ে ক্ষীর গলে নীচে পড়ে যায়।

- "এত যত্ন করে রেঁধে আনি, তবু খাবে না গো?"

আদরস্পর্শ পেয়ে তাঁর কশেরুকার হাড়গুলি শুধু খটাখট নড়ে ওঠে। কমললতা সেই মুহূর্তে খাবারের থালা আছড়ে ফেলে মাটিতে। তার সমস্ত দিনদুপুর, সাজসজ্জা, সংসারখেলা মিথ্যে হয়ে যায়।

জানলার দিকে তাকিয়ে কমললতা হাহাকার করে বলে ওঠে - "ওগো আমাকে এখান থেকে যেখানে পারো নিয়ে চলো।"


--------


বৃহস্পতিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২১

প্রেরণা বড়াল


 

কদিনের জন্য... 

------------------------

প্রেরণা বড়াল 


সুমনের মা তখন থেকে জিজ্ঞেস করেই চলেছে। 

'কি হয়েছে তোর।এতো দিন পরে ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিস। তা অমন চুপ করে আছিস কেন ? না- অফিসে কোন ঝামেলা হয়েছে।'

সুমন অনেক ক্ষণ ধরে নিজেকে সামলে রেখেছিল, আর পারল না। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল ।বলল- মা সুজন  আর বেঁচে নেই। ওকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম। 

মা বিস্ময়ের সহিত বললেন। "কি বলছিস,পরিস্কার করে বলতো?"

সুমন বলতে শুরু করলো। 

অনকটা রাত হওয়াতে ট্রেন থেকে নেমে কোন গাড়ি খালি পেলাম না। তাই ভাবলাম, ব্রিজ টা পেরিয়ে যাই ওপার থেকে অটোরিকশা নিয়ে নেব।আমি হাটতে হাটতে যখন ব্রিজের কাছে এসেছি, তখন দেখি সুজন বাইকে করে আসছে।আমাকে দেখে বলল "কদিনের জন্য?" ঠিক তখনই একটা ট্রাক ওকে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মেরে চলে যায়।

দেখতে না দেখতেই ও ছিটকে পড়ে। ব্রিজের রেলিংয়ে লেগে মাথা ফেটে- পড়ে যায় নদীর জলে। 

আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এপারে এসে কয়েকজন কে বললাম। ওরা বলল "এতো রাত্রিতে আর কিছুই করার নেই দাদা।ধাক্কা মেরে গাড়ি তো উধাও আর যে ঘায়েল হয়ে নদীতে পড়েছে সে কি এখন নিচে আছে?সে তো ভেসে গেছে কতোদুর তার ঠিক নেই। এরকম ঘটনা দু মাস আগে ও একটা ঘটেছিল। তখন খোঁজা ও হয়েছিল, কিন্তু বডি পাওয়া যায় নি। একদিন পর চর পড়া ঘাটে বডি টা পাওয়া গিয়েছিল। "

আমি কি করব বুঝতে না পারায়, 

কোন রকমে একটা অটোরিকশা করে বাড়িতে এসেছি। 

মায়ের গলা শুকিয়ে কাঠ। 

কোন রকমে বললেন,

' তুই কি বলছিস? তোর মাথা ঠিক আছে তো? ও তো দু মাস আগেই মারা গেছে ওখানে।'

সুমনের পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল। এও কি সম্ভব? এখনো সুজনের কথা ওর কানে বাজছে- কদিনের জন্য?....


মঙ্গলবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২১

তমা কর্মকার



লাল কুঠি

তমা কর্মকার



গরমের ছুটি কলেজ নেই, অনেক দিন আমাদের বন্ধুদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয় না, তাই মনটাও খারাপ বিশেষ করে আজ যখন রাই  ফোন করে জানালো তুলির শরীর খারাপ| তুলি রাইয়ের মাসতুতো বোন তুলি রাইদের বাড়ীতে থেকেই কলেজে পড়ে। তুলি  আমার প্রিয় বন্ধু | কলেজ ছুটি তাই ও ওদের বাড়ী গেছে| তুলির কোন ফোন নেই। ওর বাড়ীর নিয়ম ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত  কোন ফোন দেওয়া হবে না। যাই হোক মাকে তুলির শরীর খারাপের কথা বলে, এক দিনের জন্য     তুলিদের বাড়ী মুর্শিদাবাদের লাল কুঠিতে বেড়াতে গেলাম| গিয়ে দেখি মহারানী দিব্বি সুস্থ, আমাকে  দেখে তুলি হেসে বলল, কিরে কেমন ঢপ দিয়ে তোকে আনলাম বল? রাগ করিস নি তো? রাগ করিস না, আসলে প্রত্যেক বার তোকে আমাদের বাড়ী লালকুঠিতে আসতে বলি, তুই তো আসতে পারিস না, আর তোর আমাদের বাড়ী লালকুঠি দেখারও খুব শখ | তাছাড়া আমাকে তো বাড়ী থেকে একা কোথাও  যেতে দেবে না-- 

আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলতে হবে না, আমারও তোকে দেখতে খুব ইচ্ছা কর ছিল --

সারাটা দিন ওর সাথে গল্পে আড্ডায় খুব ভালো কাটলোl ওর মা নানা রকম রান্না করে খাওয়ালো। ওর মায়ের হাতের রান্না খুব ভালো | সন্ধ্যে বেলা ওর দাদুর ঘরে গেলাম, ওর দাদু আমাদের বসতে বললেন | আমরা বসলাম, তারপর দাদু  আমাদের সাথে  গল্প করতে লাগলেন। আমি দাদুকে বললাম, দাদু ভুতের গল্প শোনাও--তুলি ভয়ে আমার হাতটা চেপে ধরলো |ওর সারাটা গা কি ভীষণ ঠান্ডা, ঠিক মরা মানুষের গায়ের মতোl 

আমি ওকে বললাম, কিরে ভয় পেলি? 

তুলি একটু হেসে বলল, ওই আর কি, আমার আবার ভয়| কাল দেখবি তুইই আমায় ভয় পাবি, তার চেয়ে চল আমাদের বাড়ীটা তোকে ঘুরে দেখাই, আজ না দেখলে তোর আর লাল কুঠি দেখাই হবে না--

আমি ওর দিকে হা করে তাকালাম--ওর কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম নাl  তাই কোন কথা না বলে ওর পেছন পেছন সারা বাড়ীটা ঘুরে দেখলাম। জমিদার বাড়ী তো জমিদারের মতোই বিশাল অট্টালিকা,     প্রত্যেকটা ঘর কি সুন্দর করে সাজানো, ঠিক যেন ছবির মত| একটা ঘরে তুলির ছোট বেলার খুব সুন্দর একটা ছবি, ছবিটায় আমার চোখ আটকে গেলো। আমি ছবিটা মন দিয়ে দেখছিলাম। ও বলল, তোর এটা পছন্দ? 

আমি ঘাড়  নেড়ে বললাম, হ্যাঁ-- 

তুলি বলল, ছবিটা পেলে আমায় ভুলে যাবি না তো? 

আমি বললাম,  তাই কখনো হয়?

ও বলল, বেশ তাহলে তোকে ছবিটা দিলাম। সারাজীবন যত্ন করে ছবিটা রাখিস | ছবিটা আমার ভীষণ প্রিয়| আমি ছবিটা ওর থেকে ধরতেই ও যেন হওয়ায় মিলিয়ে গেলো | আমি তুলিকে ডাকতে যাচ্ছিলাম, মা আমাকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো, কিরে আর কত ঘুমাবি? বেলা    দশটা বাজে, রাই এসেছে। 

আমি তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলাম, রাই আমার কাছে এসে কান্নায় ভেঙে পড়লো, আমি বললাম কাঁদছিস কেন? 

ও বলল, কাল মুর্শিদাবাদে খুব ঝড় বৃষ্টি হয়েছে, আর তুলিদের বাড়ী লালকুঠির উপর বাজ পড়ে পুরো লালকুঠি ধ্বংস হয়ে গেছে, ওখানে তুলি সহ যারা ছিল সবাই মারা গেছে |

আমি হতভম্ম হয়ে গেলাম, বিছানার উপর তুলির ছোট বেলার ছবিটা দেখে রাই বলল, এটা এখানে কি করে এলো? আমিও কি বলবো, কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না, চুপ করে      রইলাম| 

আজও বুঝতে পারিনা স্বপ্নে যদি তুলিকে দেখি তবে তুলির ছবিটা কোথা থেকে এলো? লাল কুঠি, সে দিন স্বপ্ন দেখে ছিলাম নাকি সত্যি লাল কুঠি দেখে ছিলাম |


সন্ধ্যা রায়



 


আরাধনা কেন্দ্রম

সন্ধ্যা রায়

আমরা ব্যাঙ্গালোরে থাকি। আমি কর্ণাটকের এক  স্কুলে চাকরি করি। ওখান থেকে আমার ট্রান্সফার হয় কর্নাটকের বল্লেরী গ্রামের স্কুলে, আরাধনা কেন্দ্রম।  এ যেন আমার শাস্তি হল কিন্তু চাকরি ছাড়ার মত অবস্থা নেই। আমাদের খুব কষ্টের ভিতর চলে। বাবার উপার্জনে আমাদের সবার পড়াশোনা করা খুবই অসুবিধা। তাই আমাকে চাকরী করতেই হবে। 

মায়ের চোখের জল বন্ধ হচ্ছে না। একলা মেয়ে আমি, কি করে যাব? কোথায় থাকব? কি করে থাকবো? জায়গা কেমন? সেই সব ভেবে ভেবে অস্থির হচ্ছিলামl আমি সব ভয়-ভ্রান্তি দূর করে বল্লেরীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বল্লেরীর দূরত্ব ব্যাঙ্গালোর থেকে ৩১৫ কিলোমিটার। 

সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। পুরটাই বাস জারনি। ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরে ছুটে চলেছে বাসটা। দুপাশে সারি সারি বন-জঙ্গল, মাঝের রাস্তা দিয়ে বাসটা ছুটে চলেছে। মনটা ধুক ধুক করছে। আমার আনন্দ হচ্ছে নতুন জায়গা বলে। ভগবান একমাত্র ভরসা । বাসটা অনেকক্ষণ ছোটার পর হঠাৎ  থামল একটা ঢাবার সামনে। সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে উঠে আসলো। আমার সাথে আরও দুজন মহিলা বসে রইলেন। এখানে কিছু লোক নেমে গেল। এদিকের লোকেরা খুব কালো। ড্রাইভার এসে গাড়ি স্টার্ট করল, আবার ছুটছে গাড়ি। এদিকটা বেশ নির্জন, হঠাৎ সামনে একটা ছোট্ট গ্রাম দেখা গেলো। তখন বিকেল চারটে বাজে, বাস থেমে গেল। কন্ডাক্টার চিৎকার করছে, বল্লেরী বল্লেরী--

আমার গ্রাম এসে গেছে, আমি সুটকেস নিয়ে নেমে গেলাম। দেখি সামনে দাঁড়িয়ে একটা কালো লম্বা লোক। বিশালাকায় লোকটার চেহারা। কি যেন বলল ইংরেজি শব্দটি, বুঝলাম আরাধনা কেন্দ্র থেকে এসেছে। প্রধান অধ্যাপিকা পাঠিয়েছে। রাতে দেখলাম চাঁদ উঠেছে কিন্তু রাস্তার দু'ধারে নারকেল গাছ আর সুপারি গাছের ছায়া। আমার খুব ভয় করছিল। এই ছায়াতল থেকে যেতে গা ছমছম করছে। হেঁটে চলেছি পাহাড়ের নিচে দিয়ে। রাঙ্গা চাঁদটা গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে, ওই যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে আমাদের । কোথাও কোন লোকের সাড়াশব্দ নেই, যাচ্ছি তো যাচ্ছি।

দূর থেকে একটা লোকালয় চোখে পড়ল। বড় একটা সাদা দোতলা বাড়ি। এ ছাড়া ছোট ছোট বেশকিছু ঘর আছে। ওখানে পৌঁছে গেলাম। কালো লোকটা আমার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো, তালা খুলে দিল। তালা খুলে দিয়ে স্যুটকেসটা ভিতর রেখে লোকটা চলে গেলো। এটা আমার ঘর, ভিতরে গিয়ে দেখলাম, একটা খাটিয়া পাতা আছে। তার পাশে টেবিল আর তার উপরে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। পাশে রয়েছে একটা কাঠের উনুন। একটা পায়খানা-বাথরুম আছে। ঘরটা সিমেন্টের কিন্তু ছাউনি খড়ের। ওই লোকটা আমার সুটকেস দিয়ে চলে যাওয়ার সময় রাতে কিছু খাওয়ার পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে ও দুর্বধ্য ভাষায় কিছু বলল, আমি বুঝলাম না। আমার কাছে চিড়া-মুড়ি যা কিছু ছিল খেলাম আর খাটিয়াতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম।

সারাদিন বড় ধকল গেছে। শুয়ে পড়ে সারা দিনের কথা ভাবতে থাকলাম। কাল সকালে আশেপাশে কোন ফোন থাকলে ঘরে একটা খবর দিতে হবে, নিরাপদে পৌঁছে গেছি। মোটামুটি সব ভালো আছে। দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। কাল জয়নিং রিপোর্ট দিতে হবে। এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। আবার শব্দ হল, খসখস, যেন কেউ গাছে উঠছে ! মনে পড়ল ঘরে ঢোকার সময় একটা বড় লম্বা গাছ দেখেছি। ঘরের পাশেই লম্বা একটা তাল গাছ ছিল। এবার ভয়ে আমার বুকটা কাঁপছে--মনে হল গাছ থেকে লোকটা আমার ঘরের চালের উপর এসে দাঁড়ালো। আমি ভয়ে দুর্গানাম জপ করতে লাগলাম--দুর্গা দুর্গা দুর্গা। দেখি খড়ের চালের উপর জোরে জোরে খসখস আওয়াজ হচ্ছে। আমি ভয় পাই, চোখটা একটু খুলতেই দেখছি খড়ের চালের মাঝখান থেকে কালো লম্বা দুটো পা ঝুলে আছে। পা দুটো ক্রমশ আমার কাছ পর্যন্ত নেমে আসছে, অনেক লম্বা দুটো পা। আমি চিৎকার করে উঠলাম--মাগো বাবা গো--ব্যাস আর কিছু মনে নেই। তারপর চোখ খুলতেই দেখি অনেকেই আমার চারদিকে দাঁড়িয়ে।

আমি কোথায়? এক জন বললেন, অনেক সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিলাম, তাই হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। দুপুরে বাবা এসে পৌঁছালেন, আমাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এলেন। এবারের মত চাকরিটা আর আমার করা হল না।


সমাপ্ত 


তাপসকিরণ রায়


 স্বপ্ন সংবাদ 

তাপসকিরণ রায়


যতীন আমার বন্ধু ছিল। কে জানতো যে ও এতো স্বল্পায়ু হবে--মাত্র আঠার বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়ে যাবে ? এই তো সে দিনের কথা, যতীন এসে বলল, দেখ আজকাল আমি রাতে খুব ভয়ের স্বপ্ন দেখছি--

আমি বলে ছিলাম, স্বপ্ন কখনও সত্য নয় জানবি। 

যতীন বলেছিল--কে জানে ? জানিস, আজকাল আমি স্বপ্ন দেখি, আমি মরে গেছি, আমায় মাচান বানিয়ে বল হরি, হরি বোল, বলে শ্মশানে পোড়াতে নিয়ে যাচ্ছে-- 

আমি বলে ছিলাম, ওসব কিছু না, আমার ঠাকুরমা বলে নিজের মৃত্যুর স্বপ্ন দেখলে নাকি আয়ু আরও বেড়ে যায়-- 

--তবে ওই একই স্বপ্ন আমি রোজ রোজ কেন দেখি বল? যতীন বলেছিল। 

এরপর সাতটা দিন যেতে না যেতেই হঠাৎ এক দিন যতীন মারা গেল। স্বভাবে আমি খুব ভীতু হলেও বন্ধু যতীনের শ্মশানযাত্রায় তো  আমাকে যেতেই হত। আমিও তাই শ্মশানবন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ছিলাম। নিয়ম আছে নাকি মরদেহ সন্ধ্যের আগে দাহ করে দেওয়া ভালো। যতীন শেষ রাতে মারা গিয়েছিল। ওর গোঁঙানি শুনে ঘরের সবাই গিয়ে দেখে যতীন নিজের দু’হাত বুকে চেপে ধরে আছে আর যন্ত্রণায় খুব ছটফট করছে। এর কিছু সময়ের মধ্যেই তার দেহ স্থির হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার এসে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিল। 

আমি ভীষণ শোকাহত ছিলাম। সামনে শ্মশানে দাউ দাউ আগুনের চিতায় যতীনের দেহটা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে  আমার বুক ঠেলে একটা কান্না বারবার বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। সন্ধ্যে হয়নি তখনও যতীনের শেষকৃত্য প্রায় শেষ, সন্ধের আগেই শ্মশানের কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়েছিল। আমি দেখলাম আমার চোখ ছাপিয়ে কখন যেন কান্নার জল গাল বেয়ে নেমে আসেছে। 

শ্মশান থেকে ফিরছিলাম আমরা। শ্মশানযাত্রীরা সবাই আগে আগে চলছিল, শোকাহত আমি একটু পেছন একলা পড়ে গিয়েছিলাম। চলতে চলতে আমি অনুভব করলাম আমার দুটো কান কেমন যেন বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে ! বেশ অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। ঠিক এমনি সময়ে অবিকল একটা ফিসফিসানি অথচ স্পষ্ট কন্ঠস্বর, ঠিক যেন যতীনের কণ্ঠস্বর, আমার কানে ভেসে এলো, কিরে, কি ভাবছিস, তপন ? দেখলি  তো আমি যে স্বপ্ন দেখতাম তাই সত্যি হল ! 

--কে? কে??--আমি চমকে উঠেছিলাম। এরপর আমার চার পাশে শাঁ শাঁ শব্দে বাতাস বয়ে যাচ্ছিলো। আমার মনে হচ্ছিল,  আমার নাম ধরে যতীন যেন ডাক ছিল, তপন...তপন,,,তপন,,,  

ঠিক এমনি সময় সামনে থেকে শ্মশানযাত্রীর মধ্যে থেকে কেউ আমায় ডাক দিয়ে ছিল, এই তপন, এত পেছনে কেন ? বাড়ি যেতে হবে তাড়াতাড়ি, আয়-- 

সমাপ্ত


ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়


 

সে কে? 

ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায় 


একা একাই বেড়াতে পছন্দ করে দিবাকর। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে। ভাবুক মন। তাই বেড়ানোর স্থান বাছার ক্ষেত্রেও অন্যের পছন্দের থেকে একটু যে অন্য রকম হবে তাতে আর আশ্চর্য কি? পাহাড় পর্বত বন জঙ্গল সব তার ঘোরা চাই। তবে বড় শহর বা ঘিঞ্জি জনপদ তার পছন্দের তালিকায় নেই। কবি নয় দিবাকর। কিন্তু কবি মন তার। সে এত সুন্দর কবিতা ভাবে বা ভাবে সাহিত্য যা কিন্তু লিখতে গেলেই সব গুলিয়ে যায়। শুধু মনে হয় যা ভেবেছিল তা লিখতে পারল কই? আর যা লিখেছে তা তো ভাবে নি। সেই ভেবে লেখা ছেড়ে দিয়েছে। এখন শুধু ভাবনা নিয়েই পড়ে আছে। তার সেই ভাবনাগুলো বন্ধু বা পরিচিতদের যখন শোনায় তখন তারা অবাক হয়ে বলে কেন এইসব তুই লিখিস না দিবাকর?

সেই ভাবনাতেই এমন ফেঁসেছিল যে একটু দূরের আকাশ যে খাদের অনেক গভীরে গিয়ে মিশেছে তা খেয়ালে ছিল না। আকাশের একটা মেঘের সঙ্গে তার মন উড়ে যাচ্ছিল। আর তাতেই ঘটল বিপত্তি। খাদের প্রায় কিনারায় যে বসেছিল টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

গড়াতে গড়াতেই খাদের গভীরতা আর খাড়া কিনারার কথা ভাবতেই সমস্ত মন শিউরে উঠল। ভাবনা শূন্য মনে এখন তার শুধুই মৃত্যুর শীতল ছায়া। দু একবার গলা দিয়ে একটা আওয়াজ তোলার ব্যর্থ চেষ্টা হয়ত করে থাকবে। কিন্তু তখনই তার মনে হল তার ধারে কাছে তো একটা মাছিকেও উড়তে দেখে নি সে।

পড়তে পড়তেও সারা শরীর অবশ হয়ে আসতে থাকে দিবাকরের। এরপর আর কিছু হবে না। সে গড়িয়ে চলেছে একটা নিশ্চিত অন্ধকারের দিকে। যে অন্ধকার থেকে আলোয় আর কেউ ফিরে আসতে পারে না।

নিজেকে একেবারে নিস্তরঙ্গ করে দিয়েছে দিবাকর। আর বাঁচার চেষ্টা করা বৃথা। এবার শুধু অপেক্ষা সেই ক্ষণটার যখন কোনও অনুভূতিই পৌঁছবে না তার কাছে।

কে যেন তাকে টেনে ধরল না? তার শরীরকে পায় নি কিন্তু জামাটা টেনে ধরেছে। তার মানে কেউ আছে আর সেই টেনে ধরেছে। তার মানে আশার হ্রদ এখনও জলশূন্য হয়ে যায় নি। মাটিকে খামচে ধরল দিবাকর। এখানে গাছপালা বিশেষ নেই। যা আছে সেগুলো ছোট ছোট আগাছা।

এই যা তার জামাটা ছেড়ে এল বোধহয় উদ্ধারকারীর হাত থেকে। খানিকটা ছিঁড়ে তার হাতেই রয়ে গেছে নির্ঘাত। তবে আশা সে নিশ্চয় এগিয়ে এসে আবার তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করবে। তাই যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। সে সেই ছোট্ট ছোট্ট আগাছা আর মাটি পাথরের ডেলা খামচে ধরে উঠে আসার চেষ্টা করতে লাগল। তার নিম্নগমন রোধ হল।

এইবার একটু ওপরে তাকানোর ফুরসত হয়েছে দিবাকরের। তার উদ্ধারকারী নিশ্চয় হাত বাড়িয়ে আছে তাকে ধরার জন্যে। আশার রোমাঞ্চের সঙ্গেই সে অনুভব করতে লাগল একটা তীব্র কৌতূহল সে মহান মানুষটিকে দেখার জন্যে যে তার প্রাণ আবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

ওপরে কেউ নেই। কৌতূহলে আর একটু ওপরে তাকাল দিবাকর। মাত্র ফুট দুয়েক হবে হয়ত গাছটা। ছোট গাছ কিন্তু শক্ত তার ডাল। কয়েকটা শুকনো ডাল খোঁচা হয়ে বেরিয়ে আছে।

তারই একটা শুকনো ডালে তার জামার একটা অংশ ছিঁড়ে এখনও আটকে আছে।


শংকর ব্রহ্ম


হতবাক

শংকর ব্রহ্ম

ফরমাইশি একটা ভূতের গল্প লিখতে হবে বলে লেখার টেবিলে সবে বসেছি। এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। বিরক্তি সহকারে উঠলাম। বাড়িতে কেউ নেই। আমাকে বাড়ির পাহারায় রেখে সকলেই গেছে একটা বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে। আমার জন্য ফ্রিজে বিরিয়ানী ও চিলি চিকেন করে রেখে গেছে, রাতে গরম করে নিতে হবে। ওরা সকলে ফিরবে কাল সকালে। দরজা খুলেই বিমূঢ় বিস্ময়ে হতবাক আমি।

দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর আমার পুরণো প্রেমিকা তনয়া দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। যার জন্য আমি এক সময় পাগল হয়ে উঠেছিলাম। ভেবে ছিলাম তাকে না পেলে জীবন ব্যর্থ আমার। তা'কে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না, এমনও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। জোর করে ওর মা বাবা হঠাৎ একদিন ওর বিয়ে দিয়ে দেয় এক স্কুল মাষ্টারের সঙ্গে। আমি তখন কাঠ বেকার।

টিউশনি করে নিজের হাত খরচ চালাই। তখন আমার পক্ষে তনয়াকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। বিয়ের পরও কিছুদিন চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল ওর সঙ্গে। তখনও মোবাইল বের হয়নি।

একদিন একটা চিঠিতে ইনিয়ে বিনিয়ে কি সব লিখেছিলাম মনে নেই আজ আর। তবে তা'তে দু'টো লাইন লিখেছিলাম মনে আছে আজও।

লাইন দু'টো ছিল -

"খুব বেশী দুঃখ পেলে চলে এসো আমার কাছে, তোমার জন্য বুকে আমার অনেকখানি জায়গা আছে।"

সেই চিঠি লেখা খামখানা পড়েছিল ওর বরের হাতে। তারপর থেকেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সম্পর্কের ইতি। প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা।

তারপর এত বছর পর পুনরায় তার দেখা পেয়ে মনটা বিগলিত হয়ে উঠল। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে তার। চুলগুলো সাদা শনের নুড়ি, অনেকগুলো দাঁত পড়ে গিয়ে, গাল দু'টো চুপসে ভিতরে বসে গেছে। কুৎসিৎ কদাকার রূপ। এর জন্যই আমি এক সময় পাগল হয়েছিলাম, ভেবে অবাক হলাম। তবুও পুরণো প্রেমিকা বলে কথা।

যত্নে আপ্যায়ণ করে ঘরে এনে বসালাম তাকে। আমার জন্য ফ্রিজে রাখা বিরিয়ানী চিলিচিকেন মাইক্রো ওভেনে গরম করে তাকে খেতে দিলাম। তারপর ফ্রিজ থেকে দই মিষ্টি দিলাম। তৃপ্তি করে সে খাওয়ার পর, তাকে বিছানায় ফেলে অপর্যাপ্ত আদর করলাম।

সে খুব খুশি হয়ে ঘন্টাখানেক থাকার পর চলে গেল। যাওযার সময় আমি তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললাম, আবার এসো একদিন।

সে মুচকি হেসে কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেল।

পরদিন সকালে অবনী ( তনয়ার মাসতুত দাদা) ফোন করে জানাল, তনয়া মারা গেছে কাল, হার্ট অ্যাটাকে। অবনী আমার বন্ধু, সেই সূত্রেই তনয়ার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল।

তনয়া ওর মামাতো বোন। আলাপের কিছুদিন পরেই আমরা পরস্পরের প্রেমে পড়ি। বছর খানেক প্রেম চলার পর তনয়ার আচমকা বিয়ে হয়ে যায়।

আমি অবনীর কাছে জানতে চাই, কবে কখন কবে, কখন ঘটনাটা ঘটল?

অবনী বলল, কাল সন্ধ্যা সাতটায়।

আমি তার কথা শুনে হতবাক ! 

তা কি করে সম্ভব?সেই সময়টাতেই তো তনয়া আমার কাছে এসেছিল কাল। আমি অবনীকে আর কিছু বলতে পারলাম না। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।


সোমবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২১

সান্ত্বনা চ্যাটার্জী


গল্পকারের শেষ গল্প 

সান্ত্বনা চ্যাটার্জী 

 

রোজকার মতনই অফিসে অফিসে ঘুরে চাকরি না পাওয়ার ব্যর্থতা নিয়ে ভিড় বাসে বাড়ি ফিরছিলাম হঠাৎ করেই চোখে পড়লো রাস্তার ধারে একটি বুড়ো লোক ভিক্ষার কৌটো হাতে বসে। বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত  করে উঠল, কেষ্টদা না?

স্টপেজ এসে গেছিল , বাস থেকে নেমে লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম । ইতস্তত করে ডাকলাম কেষ্টদা !

চমকে আমার দিকে চেয়ে খানিক থেকে কেষ্টদার চোখদুটো জ্বল জ্বল করে উঠল।

বিল্টুবাবু ! তুমি এখানে বসে কেন ! তুমি কোন্নগরে থাকতে না?

.......

কোন্নগরে আমার মামাবাড়ি আর কেষ্টদা সেখানে বাড়ির কাজ করত। আমাদের মানে বাড়ির ছোটোদের সংগে খুব প্রিয় ছিল।

কেষ্টদা মানেই গল্পের ঝুলি । যথনই যেতাম দুপুরে আর রাতে খাবার পর আমাদের শোবার ঘরে কেষ্টদাকে ঘিরে গল্প শুনতে বসতাম । কত রকম গল্প ভূতের, ডাকাতের, জংগলের কেষ্টদার গল্পের ঝুলি কোনো সময় খালি হতো না।

কেষ্টদা তুমি তো লেখা পড়া জানো না তো এতো গল্প জানো কি করে?

এ সবই আমার না-লেখা গল্প ।

সব গল্প তুমি নিজে বানিয়ে বল? তুমি পড়ালেখা করলে মস্ত বড় গল্পকার হতে, তখন তোমার লেখা বই বিক্রি করেই বড় লোক হয়ে যেত।আমরা আশ্চর্য হয়ে বলতাম।

........

কি আর করব বিল্টুবাবু কপাল !

মানে !

হঠাৎ কি মনে হল কেষ্টদার মুখটা শুকনো। খাও কোথায়, থাকো কোথায় !

সামনের গলিতে একটা দোকান আছে, খুব ভালো কচুরি বানায় কেষ্টদাকে নিয়ে কচুরি আলুর দম নিলাম কেষ্টদার জন্য আমি চা নিলাম। কেষ্টদাকে কচুরি আর আলুরদম দিয়ে গেল দোকানের ছেলেটা । কেষ্টদার খাওয়া দেখে চোখ সবিয়ে নিলাম; কতদিন মনে হয় পেটে কিছু পড়েনি । আমার বুকটা ব্যথায় দুমড়ে মুচড়ে একাকার। তিন প্লেট কচুরি শেষ করে মুখ তুলল আহ্ কতো দিন পরে এমন খেলাম।

আরো দুকাপ চা আনতে দিয়ে বললাম-এবার বলো।

চা খেতে খেতে কেষ্টদা যা বলল তার সারমর্ম হলো বড় মামা মারা যাবার পর কেষ্টদার চাকরিটা রইল না। কেষ্টদা বড় মামার খাস চাকর ছিল । বড় মামা বিয়ে করেন নি, কেষ্টদাই দেখাশোনা করত। বড়মামা মারা যাবার পরে ছোটোমামা কেষ্টদার হাতে কিছু টাকা দিয়ে আর একটা ব্যাঙ্ক একাউন্ট কেষ্টদার নামে খুলে দিয়েছিলেন। এতো বছর কেষ্টদার খাওয়া থাকার কোনো খরচ ছিল না। কেষ্টদার মাইনের টাকা সেখানেই জমা হত। বেশ কিছু টাকা জমেছিল।

বাড়িতে ফিরে কেষ্টদা টাকা আর ব্যাঙ্কের বই বৌএর কাছে দিয়ে নিশ্চিন্ত। বৌ সংসার ভালই চালাচ্ছিল কিন্তু কেষ্টদার ডেঙ্গু জ্বর হওয়াতে হাসপাতালে ভর্তি ছিল , কেষ্টদা নি:সন্তান , কেষ্টদার টিপ সই দেওয়া চেক বই ছিল। সেই সুযোগে পাড়ার দর্জি হালিমের সাথে টাকা কড়ি হাতিয়ে পালায়। হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসে দেখে ঘরের সব কিছু ফাঁকা করে নিয়ে পালিয়েছে দুজনে।  

আসে পাশের লোকেরা বলল আপনি সরল মানুষ তাই বোঝেন নি, দুজনার মধ্যে অনেক দিন ধরেই চলছিল, যখন যখন ছুটিতে আসতেন তখন সামলে চলত।

হাসপাতালে বৌ কদিন ধরে আসেনি কেষ্টদা ভেবেছিল তারও জ্বর। প্রতিবেশীরা বলেছিল নাকি দক্ষিন কলকাতায় হাজরার কাছে ওরা থাকে। প্রতিবেশীদের কাছে কিছু টাকা ধার করে এসেছিল কিন্তু এখানে এসে কিছুই খুঁজে পায়নি। টাকা পয়সা শেষ এখন তাই ভিক্ষাপাত্র।

দেশে ফেরার জন্য রেল টিকিটের দাম ও হাত খরচার জন্য কেষ্টদার হাতে পর্যাপ্ত টাকা দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরলাম। মা সব শুনে বললেন সে কি, কেষ্টদার তো বৌ অনেক কম বয়সেই মারা গেছে। যতদূর জানি ওর সাত কুলে কেউ নেই। ভীষণ নেশা করত আর চুরি করত বলে মামারা ছাড়িয়ে দেয়।

হঠাৎ কি মনে হওয়ায় প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম মানিব্যাগ নেই।




কাজল সেন


 


কাজল সেন

সুখে আছে তরুণিমা

 

ইদানীং তরুণিমার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় শ্যামসুন্দরের। হয়তো তখন দুজনেই কোথাও যাবার জন্য হন্তদন্ত হয়ে চলেছে অটোস্ট্যান্ডে। অথবা হয়তো রিফাইন তেলের প্যাকেট কিনে শ্যামসুন্দর তার ঘরে ফিরছে, আর তরুণিমা ভ্রু প্লাক করতে যাচ্ছে কোনো লেডিজ পার্লারে। তা দেখা হলেই কিছু কথা হয়। হয়তো, যতসব অপ্রাসঙ্গিক এবং অসংলগ্ন কথা। কিন্তু! তবুও!

--“আজ বেশ ঠান্ডা পড়েছে, তাই না?” শ্যামসুন্দর বলে।

--“হ্যাঁ, কাল মনে হয় আরও জাঁকিয়ে পড়বে!আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে তরুণিমা বলে।

--“নাও পড়তে পারে, হয়তো কাল হঠাৎ ঠান্ডা কমে গেল, গরম পড়ে গেল!

--“তা যা বলেছো! তোমার অনুমান তো মাঝে মাঝে ঠিকঠাক লেগেও যায়!

--“তাই! তবে কী জানো তরু, এভাবে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলে তো খুব মুশকিল! তাই না?”

--“কেন? মুশকিল কেন?”

--“না, আমার ভালো লাগে না। সব কিছু গোছানো থাকবে, তবেই না আনন্দ!

--“না শ্যামসুন্দর, এটা ঠিক কথা নয়। এলোমেলো হলো, তো কী হলো! যত এলোমেলো হবে ততই তো মজা হবে! সুখ হবে। গতানুগতিকতা ও একঘেয়েমি কাটবে! না হলে তো সবাই আমরা অসুখে ভুগবো!

শ্যামসুন্দরের ব্যস্ততা আছে। তেল পৌঁছলে মা রান্না চাপাবে। অথচ তরুণিমাকে ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করে না। কী যে আছে এই মেয়েটির মধ্যে!

মনোরমা একদিন তরুণিমাকে বলল, “তুই মাঝে মাঝেই জঙ্গলে চলে যাস্‌। কী ব্যাপার বল্‌ তো তরু! জঙ্গলে তোর কোনো প্রেমিক থাকে নাকি? তার সঙ্গে দেখা করতে যাস্‌? তোরা জঙ্গলে অনেক কিছু করিস্‌, তাই না?”

তরুণিমা হাসে, “হ্যাঁ, আছে তো! আমার প্রেমিক থাকে জঙ্গলে। আমরা তো মিলিত হই!

চোখ উলটে যায় মনোরমার, “সে কী রে! আর কোথাও জায়গা পেলি না, একেবারে জঙ্গলে?”

তরুণিমা কীভাবে মনোরমাকে বোঝাবে যে, তার প্রেমিক গাছেরা জঙ্গলেই যে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করে! তাদের সঙ্গে সহবাসের জন্য তাই তাকে জঙ্গলেই যেতে হয়। আর গাছেদের সঙ্গে সহবাসে কী যে সুখ, তাই বা সে কেমন করে মনোরমাকে বোঝাবে! তরুণিমা জানে, মনোরমা তার ফিয়াসেঁ হরিহরের সঙ্গে লাগামছাড়া মিলিত হয় নিজেদের বাড়িতেই। তা সেই সুখ নিয়েই থাকুক মনোরমা।

তরুণিমার তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু তরুণিমার সুখ তো আর মনোরমার কখনই সইবে না! শ্যামসুন্দরেরও সইবে না।

সত্যি সত্যিই, খুব সুখে আছে তরুণিমা। 



এটি একটি ভৌতিক সংখ্যা

এটি একটি ভৌতিক সংখ্যা